শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:২১ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সুষ্ঠু আয়োজন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন

রাজেকুজ্জামান রতন:

আন্দোলনের মাঠ গরম হয়ে উঠছে আর আলোচনা সরগরম হয়ে উঠছে নির্বাচন নিয়ে। স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু হলেই শুরু হয়ে যায় নির্বাচনে কারচুপির আশঙ্কা। আর এ ক্ষেত্রে সামনে চলে আসে নির্বাচন কারা পরিচালনা করবেন সেই প্রশ্ন। কারণ অতীতের অভিজ্ঞতা তো সুখকর নয়। নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, নির্বাচনে প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা কী হবে এসব প্রশ্ন তো আছেই, এর সঙ্গে এবার বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ইভিএম। ইভিএম কারা চায় এবং কেন চায় আর কারা চায় না এবং তারা কেন চায় না এই প্রশ্নে যন্ত্র যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়েও বেশি সংকট ব্যবস্থাপনা নিয়ে। সেটা ব্যালটে বা ইভিএম যেভাবেই ভোটগ্রহণ হোক না কেন?

নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রতিটি জেলায় একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পান। দীর্ঘকালের ধারাবাহিকতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক (ডিসি) তার জেলার সব নির্বাচনী এলাকার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আবার ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় বিভাগীয় শহরে নির্বাচনী এলাকাগুলোয় বিভাগীয় কর্মকর্তাকে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জাতীয় সংসদের শূন্য আসনে উপনির্বাচনসহ সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদেরই রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়ে থাকে। জেলা প্রশাসকরা সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন তাই প্রস্তাব এসেছে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করার। ধারণা করা হচ্ছে কমিশনের কর্মকর্তারা স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের আওতায় থেকে নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কথায় যুক্তি আছে, জনগণ চায় সুষ্ঠু নির্বাচন আর নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন। সুতরাং, রিটার্নিং কর্মকর্তা তাদেরই করা হোক যারা সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় সৃষ্টি করবেন না।

নির্বাচন-সংক্রান্ত আইনে নির্বাচন কমিশনের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন নামক একটি বহু প্রাতিষ্ঠানিক কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে কোন কর্মকর্তা কীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনী এই কাজে পুলিশ, সামরিক বাহিনী ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, এমনকি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা ও শিক্ষকরা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন।

জেলায় যে রিটার্নিং কর্মকর্তা তার ক্ষমতার উৎস কী? তাদের ক্ষমতার পরিধি নির্ধারণ করে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন, পরিচালনা বিধিমালা ও আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু আইন ও বিধি প্রণয়ন করা থাকলেই যে তা কার্যকর হয় না এ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি আর কোন দেশের মানুষের আছে? ফলে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের জন্য মানসিকতার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও স্বীয় পর্যাপ্ত জনবল এবং অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই কম নয়। প্রতিষ্ঠানের ব্যাপ্তি আর সক্ষমতাই কি নির্বাচন নিরপেক্ষ করার জন্য প্রধান বিষয়? মনে হয় না। কারণ ভারতে শ-তিনেক জনবলের একটি নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে থাকেন। নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কর্মকর্তাদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন কাজ করিয়ে নেয়। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের জনবলকাঠামো এরই মধ্যে সাত হাজারের কাছাকাছি হয়েছে এবং তা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব আছে।

ধরে নেওয়া হয় জেলার ডিসিরা সরকারের খুব কাছের লোক। সরকারি কাঠামোয় সীমাহীন দলীয়করণ জেলা শাসকদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে, এ বিষয় নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ এখন নেই। কিন্তু অন্যদিকটাও দেখা দরকার। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ দেশে অনুষ্ঠিত চারটি আপাতগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাঠপর্যায়ের নেতৃত্বে ছিলেন কিন্তু ডিসিরাই। আবার ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একতরফা একটি নির্বাচনেও তারাই ছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। সে নির্বাচনের পর সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর গঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আগের মাত্র ১৯ জন ডিসিকে মাঠ থেকে প্রত্যাহার করে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা সবাই মিলে ১৯৯৬ সালের জুনের সফল নির্বাচনটির ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব দেন। তাহলে শুধু ডিসিরাই সমস্যা নন, সমস্যাটা ছিল ক্ষমতায় থাকা দলীয় সরকার। তারা যদি যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় তাহলে নির্বাচন আর নিরপেক্ষ থাকে না, একতরফা হয়ে যায়।

যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এত বিতর্ক সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল মূলত ডিসিদের মাধ্যমেই। সুতরাং ডিসিরা পারেন না এই যুক্তিতে তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা না রাখার বিষয়টি ভালোভাবে ভাবতে হবে। আবার নির্বাচন পরিচালনায় প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশের ভূমিকা প্রয়োজনীয় এবং বিতর্কিত। পুলিশকে যে দলীয়করণ করা হয় সেটা ব্যাখ্যা করার দরকার কী আছে? বিগত দুটি নির্বাচন ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছে তাকে কী বলা যায়? এই নির্বাচনে প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা তো ভুলে যাওয়ার কথা নয়।

মধ্যরাতের নির্বাচন কথাটা এখন বেশ চলতি কথা। তো সেই মধ্যরাতে ভোটের বাক্স ভর্তি করার দায়িত্বে কারা ছিল? এটা কি সবার জানা নেই? তাই বলে এ ধরনের সংস্থাকে নির্বাচনের দায়িত্ব থেকে বাদ দেওয়া যাবে কি? অন্যদিকে, মাত্র কদিন আগে খবর বেরিয়েছে নির্বাচন কমিশনের সব কর্মকর্তাসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা গোয়েন্দা সংস্থা যাচাই করেছে। কেন এবং কোন ক্ষমতায় তারা এটা করেছেন তার কোনো ব্যাখ্যা বা প্রতিবাদ কমিশনের পক্ষ থেকে এখনো দেওয়া হয়নি। গোয়েন্দা কর্র্তৃপক্ষ কেন এটা করেছেন বা এর মাধ্যমে কী বার্তা দিলেন তার কোনো ব্যাখ্যাও কি ভোটার বা জনগণ পেয়েছে?

সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সত্তা। তাহলে গোয়েন্দা সংস্থা বা তদন্ত নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কেন এটা বোধগম্য হলো না। এ কি সরকারের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার সন্দেহকে ঘনীভূত করবে না? কারণ ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত যেসব কমিশন গঠিত হয়েছে, সেগুলো দু-একটা সিটি কেেপারেশন নির্বাচন সফলভাবে করতে পারলেও জাতীয় নির্বাচনে জনগণের আস্থা অর্জনে সফল হয়নি। তখন রিটার্নিং কর্মকর্তারাও ছিলেন তাদের কর্মকর্তা। সেসব নির্বাচনে ডিসিদের মতো একই ভূমিকা কমিশনের কর্মকর্তারা কি পালন করেননি? আসলে কমিশন যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখন তার কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবেন এটা সম্ভব নয়।

যেকোনো নির্বাচনে মূল বিষয় হলো রাজনৈতিক সমঝোতা এবং আস্থা। এই সংকট নিরসনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। ২০০৯ সালে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনায় ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এ ক্ষেত্রে আদালতের একটি বিভক্ত আদেশ সংবিধান সংশোধন করতে তাদের সহায়তা করেছে। আদালতের সেই আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন করেছে তারা এবং বিতর্ক কমছে না, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ছে না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতার বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস সৃষ্টি করা নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। তবে তাদের বক্তব্য আস্থার সংকট যে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে সেটা কমিশনার এবং প্রধান কমিশনারের কথাবার্তা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না।

একদিকে আস্থার সংকট, অন্যদিকে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে ইভিএম ব্যবহারে বেশির ভাগ দলের আপত্তি সত্ত্বেও ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের ঘোষণা এবং ইভিএম কেনার জন্য টাকা বরাদ্দের তৎপরতা নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ডলারের রিজার্ভ কমে যাওয়া, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, বিশ্বব্যাপী নানা সংকটের কথা বলে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে যখন ব্যয় সংকোচনের কথা বলা হচ্ছে, যখন আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে, তখন নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানালেন, আগামী নির্বাচনে দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট করার জন্য মাত্র ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা দিয়ে ২ লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনা হবে। তাদের হিসাবে মেশিনপ্রতি দাম পড়বে মাত্র ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৫৫০ টাকা। এত দাম আর পেপার অডিট ট্রেইল থাকবে কি না এই সন্দেহ সত্ত্বেও এ যেন টানাটানির সংসারে গাড়ি কেনার পরিকল্পনার মতো।

এর মধ্যেই খবর বের হলো, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে, অর্থাৎ ২০১৮ সালে ইসি ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা দিয়ে যে দেড় লাখ ইভিএম কিনেছিল (যার প্রতিটির দাম পড়েছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা) তার ২৮ হাজারই নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। বিকল ইভিএমগুলোর ‘ওয়ারেন্টি ডেট’ থাকলেও সেগুলো বিনা খরচে মেরামত করে কাজে লাগানো যাবে কি না তা পরিষ্কার জানা যায়নি এখনো।

এখন ছোটবেলায় শেখা পাটিগণিত অনুযায়ী একটু হিসাব করে দেখা যাক। নতুন ইভিএম কিনতে খরচ হবে ৮,৭১১ কোটি টাকা, আগের ইভিএম কিনতে খরচ হয়েছিল ৩,৮২৫ কোটি টাকা। তাহলে ইভিএম কেনা বাবদ খরচ দাঁড়ায় ১২,৫৩৬ কোটি টাকা। ১ মার্চ নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে দেশে ভোটারের সংখ্যা ১১ কোটি ৩২ লাখ ৫৮ হাজার ৩৫১ জন। ৩০০ আসনে এই পরিমাণ ভোটার হলে ১৫০ আসনে তার অর্ধেক হবে। ১৫০ আসনে ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৬৬ লাখ ২৯ হাজার। তাহলে ইভিএম যন্ত্র বাবদ এই দেড়শ আসনে প্রত্যেক ভোটারের পেছনে খরচ কত হবে, দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনে ভোটারপিছু শুধু ইভিএম কেনা বাবদ খরচ হবে ২ হাজার ২১৪ টাকা। এর বাইরে পরিচালনা ব্যয় তো আছেই। এই বিপুল ব্যয় করে বাড়তি হিসেবে আমরা পাব আপত্তি, অসন্তোষ আর আশঙ্কা।

ইভিএম অথবা ব্যালট, ডিসি অথবা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা এসব বিতর্ক কোনোটাই জটিল বিষয় নয় যদি নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসা যায়। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দরকার দলীয় সরকার নয়, নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার। এই সিদ্ধান্তে যত দ্রুত আসা যায় ততই দ্রুত নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ ও সংঘাত এড়ানো সম্ভব হবে।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট

rratan.spb@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION